কিডনি (বৃক্ক) মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনির তুলনা সুপার কম্পিউটারের সঙ্গে করা উচিত কারণ কিডনির গঠন এবং কার্য অতীব জটিল।
কিডনি শরীরের রক্ত পরিষ্কার করে মূত্র তৈরি করে। শরীর থেকে মূত্র নিষ্কাশন করার কার্য মূত্রবাহিনী (Ureter) মূত্রাশয় (Urinary Bladder) আর মূত্রনালিকা (Urethra) দ্বারা হয়ে থাকে।
- স্ত্রী ও পুরুষ দুজনের শরীরেই সাধারণত দুটি কিডনি থাকে। কিডনি পেটের ভিতরে, পিঠের দিকে, মেরুদন্ডের দুই পাশে কোমরের অংশে অবস্থিত।
- কিডনির আকার সিম বীজের মতো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কিডনি সাধারণত ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, ৫ সেন্টিমিটার চওড়া আর ৪ সেন্টিমিটার মোটা হয়। প্রতিটি কিডনির ওজন ১৫০-১৭০ গ্রামের মধ্যে হয়।
- কিডনির দ্বারা প্রস্তুত মূত্র মূত্রাশয় পর্যন্ত মূত্রবাহিনী নালী দ্বারা পৌঁছায়। মূত্রবাহিনী নালী সাধারণত ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয় আর বিশেষ প্রকারের রাবার জাতীয় (Elastic) মাংসপেশী দ্বারা তৈরি হয়।
- মূত্রাশয় পেটের নীচের অংশে সামনের দিকে (তলপেট) অবস্থিত একটি স্নায়বিক থলি, যার মধ্যে মূত্র জমা হয়।
- যখন মূত্রাশয়ে ৩০০-৪০০ মিলিলিটার (ml) মূত্র জমা হয় তখন মূত্রত্যাগের বেগ আসে। মূত্রনালিকা দ্বারা মূত্র শরীর থেকে বাইরে আসে।
স্ত্রী ও পুরুষের ক্ষেত্রে কিডনির অবস্থান এবং কার্যপ্রণালী একই হয়

কিডনির কার্যপ্রণালী:
কিডনির প্রয়োজন এবং গুরুত্ব:
- প্রত্যেক ব্যক্তির আহারের ধরন ও মাত্রা প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়।
- আহারের মধ্যে বৈচিত্র্যের কারণে শরীরে জল, অম্ল ও ক্ষারের মাত্রা নিরন্তর পরিবর্তিত হয়।
- আহারের পাচন প্রক্রিয়ার সময় অনেক অনাবশ্যক পদার্থ শরীরে উৎপন্ন হয়।
- শরীরে জল, অম্ল বা ক্ষারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের মাত্রার ভারসাম্য নষ্ট না হলে তা মানুষের পক্ষে হানিকারক বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
- কিডনি শরীর থেকে অনাবশ্যক দ্রব্য বা পদার্থ মূত্র হিসাবে শরীর থেকে বের করে রক্তের পরিশোধন করে এবং শরীরে ক্ষার এবং অম্লের ভারসাম্য বজায় রাখে। এইভাবে কিডনি শরীরকে স্বচ্ছ এবং সুস্থ রাখে।
কিডনির প্রধান কার্য কী?
কিডনির প্রধান
কার্যগুলি হল:
১. রক্তের পরিশোধন: কিডনি নিরলসভাবে সর্বক্ষণ শরীরে উৎপন্ন অনাবশ্যক পদার্থগুলিকে মূত্রদ্বারা শরীর থেকে দূর করে।
২. শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখা:
কিডনি শরীরের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল মূত্রদ্বারা শরীর থেকে বাইরে বের করে।
৩. অম্ল এবং ক্ষারের ভারসাম্য বজায় রাখা:
কিডনি শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফেটস, বাই কার্বনেট ইত্যাদির মাত্রা যথাযথ রাখার কাজ করে। সোডিয়ামের মাত্রা বাড়া বা কমার সঙ্গে মাথার উপর, আর পটাশিয়ামের মাত্রা বাড়া-কমার সঙ্গে হৃদয় বা স্নায়ুতন্ত্রের গতিবিধির গভীর প্রভাব পড়তে পারে।
৪. রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণ:
কিডনি অনেক হরমোন নিঃসরণ করে যেমন অ্যানজিওটেনসিন, অ্যালডোস্টেরন, প্রোস্টাগ্ল্যানডিন।
এই হরমোনগুলির সাহায্যে শরীরে জলের মাত্রা, অম্ল এবং ক্ষারের ভারসাম্য বজায় থাকে। এই ভারসাম্যের দ্বারা কিডনি শরীরে রক্তচাপ বজায় রাখার কাজ করে।
৫. রক্তকণিকা উৎপাদনে সাহায্য:
রক্তে উপস্থিত লোহিত রক্ত কণিকায় (RBC) সৃষ্টি এরিথ্রোপোয়েটিন হরমোনের সাহায্যে অস্থিমজ্জাতে (Bone Marrow) হয়। এরিথ্রোপোয়েটিন কিডনি দ্বারা প্রস্তুত হয়। কিডনি বিকল (Fail) হলে এই হরমোনের নিঃসরণ কমে যায় বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, যারা ফলে রক্ত ফ্যাকাসে হয়ে যায়, যাকে অ্যানিমিয়া (রক্ত কমে যাওয়ার রোগ) বলে।
৬. হাড়ের স্বাস্থ্য:
কিডনি সক্রিয় ভিটামিন-'ডি', তৈরি করতে সাহায্য করে থাকে। এই ভিটামিন-'ডি', শরীরে ক্যালসিয়াম আর ফসফরাসের জরুরি মাত্রা বজায় রেখে হাড় এবং দাঁতের বিকাশ ও মজবুত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্য করে থাকে।
কিডনিতে রক্তের পরিশোধনের পরে মূত্র কীভাবে সৃষ্টি হয়?
সারাদিনে কত পরিমাণ মূত্র তৈরি হবে তা নির্ভর করে (১) কত পরিমাণ জলপান করি (২) শরীরে জলের মাত্রা (৩) শরীরে হরমোন ADH-এব মাত্রার উপর (৪) কিডনির সুস্থতার উপর। কিডনি যদি অসুস্থ হয় এবং GFR (Glomerular Filtration Rate) কমে; তখন মূত্র তৈরি করার ক্ষমতাও কমে।
কিডনি প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহকে রেখে অপ্রয়োজনীয় পদার্থগুলিকে মূত্রদ্বারা শরীরের বাইরে বের করে। এটি একটি অনন্য, অদ্ভুত তথা জটিল প্রক্রিয়া।
আপনি কি জানেন?
শরীরের কিডনিযুগলে প্রতি মিনিটে ১২০০ মিলিলিটার রক্ত পরিস্তুত হবার জন্য আসে, এটি হৃদয়দ্বারা শরীরে পৌঁছানো রক্তের ২০% এইভাবে আনুমানিক প্রতি ২৪ ঘণ্টাতে ১৭০০ লিটার রক্ত পরিস্তুত হয়।
রক্ত পরিস্তুত একক (Functional Unit) নেফ্রন একটি ছাঁকনির মতো কাজ করে।
প্রত্যেক কিডনিতে দশ লক্ষ নেফ্রন থাকে। নেফ্রন প্রধানত দুটি অংশে বিভাজিত, গ্লোমেরুলাস এবং টিউবিউলস। আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে গ্লোমেরুলাস নামক ছাঁকনি প্রত্যেক মিনিটে ১২৫ মিলিলিটার মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে ২৪ ঘন্টাতে মোট ১৮০ লিটার মূত্র সৃষ্টি করে থাকে। এই ১৮০ লিটার মূত্রের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ, ক্ষার এবং বিষাক্ত পদার্থ থাকে। একই সঙ্গে এর মধ্যে প্রয়োজনীয় পদার্থ, যথা গ্লুকোজ এবং অন্য পদার্থও থাকে।
গ্লোমেরুলাস দ্বারা সৃষ্ট ১৮০ লিটার মূত্র টিউবিউলসে আসে, যেখানে ৯৯% দ্রব্য পুনঃশোষিত (Reabdorption) হয়।
কিডনির প্রধান কার্য হল রক্ত পরিশোধন করা এবং শরীরে ক্ষার এবং জলের ভারসাম্য বজায় রেখে মূত্র সৃষ্টি করা।
টিউবিউলসে হওয়া পুনঃশোষণকে বুদ্ধিদীপ্ত পুনঃশোষণ বলে কেন?
ইহার কারণ ১৮০ লিটারের মতো অধিক মাত্রাতে সৃষ্ট মূত্রের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় পদার্থ এবং জল পুনরায় শরীরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কেবলমাত্র ১ থেকে ২ লিটার মূত্রের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ এবং অ্যাসিড (Acid) শরীরের বাইরে নিষ্কাশন করা হয়।
এইভাবে কিডনি দ্বারা নানাবিধ জটিল পরিশোধন প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রস্তুত মূত্র মূত্রবাহী নালিকার দ্বারা মূত্রাশয়ে জমা হয় এবং মূত্র নালিকার দ্বারা শরীরের বাইরে নিষ্কাশিত হয়।
সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তির কি প্রস্রাবের মাত্রা বেশি/কম হতে পারে?
হ্যাঁ। প্রস্রাবের পরিমাণ জলপান এবং আবহাওয়ার তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। যদি কোনও ব্যক্তি কম জল পান করে তাহলে গাঢ় মূত্র ত্যাগ করে। সারাদিনে (৫০০ ml) মূত্র দূষিত পদার্থ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট। অধিক জল পান করলে অধিক এবং পাতলা মূত্র সৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মকালে অত্যধিক ঘাম হবার জন্য প্রস্রাবের মাত্রা কমে যায়, আর শীতকালে ঘাম কম হবার জন্য প্রস্রাবের মাত্রা বেড়ে যায়।
সাধারণ জল পান করার পরে যদি কোনও ব্যক্তির মূত্র ৫০০ মিলিলিটার (অর্ধেক লিটার) এর কম অথবা ৩০০০ মিলিলিটার (৩ লিটার)-এর বেশি হয় তাহলে সেটা কিডনির রোগ শুরুর প্রথম লক্ষণ।
২৫০০-৩০০০ মিলিলিটার-এর কম জল পান করার পরেও যদি মূত্র ৩ লিটারের বেশি হয় এবং জল পিপাসা বাড়ে, তাহলে কিডনির অসুখ যেমন ডায়াবেটিস ইনসিপিটাস (Diabetes Insipidus) এই রোগ Diabetes Mellitus থেকে আলাদা।
প্রস্রাবের মাত্রা অত্যধিক কম বা বেশি কিডনি রোগের সংকেত