কিডনির বেশ কিছু রোগ খুব গম্ভীর হয়। আর এই রোগের সময়ে চিকিৎসা না হলে ক্ষতিকর হতে পারে। ক্রনিক কিডনি ফেলিওরের মতো রোগ পুনরায় পুরোপুরি ঠিক হয় না। এবং অন্তিম পর্যায়ে যার চিকিৎসা, যেমন ডায়ালিসিস আর কিডনির প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। এইসব সুবিধা সব জায়গাতে পাওয়া যায় না। এই কারণে, 'Prevention is Better Than Cure' এই প্রবাদবাক্যের অনুসরণ করা দরকার। কিডনিকে খারাপ হবার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সবার জানা দরকার।
এটি নিম্নলিখিত দুই ভাগে বিভক্ত
- সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তির জন্য তথ্য
- কিডনি রোগীদের সেবাসুশ্রূষার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য
স্বাভাবিক ব্যক্তির জন্য তথ্য
১. কিডনিকে সুস্থ রাখার জন্য সাধারণ সূচনা:
- রোজ 3 লিটারের বেশি (১০-১২ গ্লাস) জল পান করা দরকার (যাদের শরীরে ফোলাভাব দেখা যায় না)।
- নিয়মিত শরীরচর্চা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- 40 বছরের বেশি বয়স্কদের খাবারে নুনের মাত্রা কম করা।
- ধূমপান, তামাক, গুটকা, মদ্যপান না করা।
- ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া অনাবশ্যক ওষুধ না খাওয়া।
২. পরিবারে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপের এবং পলিসিসটিক কিডনির রোগী থাকলে প্রয়োজনীয় সূচনা:
ডায়াবিটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের রোগ বংশানুক্রমিক। যদি পরিবারে এই রোগ থেকে থাকে তাহলে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কুড়ি বছর বয়সের পর থেকে বছরে একবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে নেওয়া দরকার যে এই দুটি রোগের উপস্থিতি আছে কি না।
৩. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
৪০ বছর বয়সের পর থেকে, শরীরে কোনও অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও, পরীক্ষা করালে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, মূত্র, ক্রিয়েটিনিন এবং ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি কিডনির অনেক রোগ সংক্রান্ত লক্ষণ জানতে পারা যায়।
কিডনির রোগ হবার পর প্রয়োজনীয় সাবধানতা
১. কিডনি রোগের তথ্য এবং প্রাথমিক নির্ণয়:
মুখমণ্ডল আর পায়ে ফোলাভাব, খাবারে অরুচি, বমিভাব, রক্ত ফ্যাকাসে হওয়া, দীর্ঘ সময় ধরে দুর্বলতা, রাত্রে অনেক বার প্রস্রাব করতে ওঠা, প্রস্রাব করতে অসুবিধা হওয়ার মতো লক্ষণ কিডনি রোগের সংকেত হতে পারে।
এইসব অসুবিধায় পীড়িত ব্যক্তির যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। উপরোক্ত লক্ষণের অনুপস্থিতিতে, যদি প্রস্রাবে প্রোটিন লক্ষ করা যায়, বা রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলেও কিডনির রোগ হয়ে থাকতে পারে। কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থাতে নির্ণয়, রোগের প্রতিরক্ষা, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. ডায়াবিটিসের রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা:
ডায়ালিসিসে আসার রোগীদের প্রত্যেক তিনজনের মধ্যে একজনের কিডনি পুরোপুরি বিকল হবার কারণ হল ডায়াবিটিস।
এই গভীর সমস্যাকে প্রতিরোধ করার জন্য ডায়াবিটিসের রোগীদের সর্বদা ওষুধ এবং চিকিৎসার দ্বারা ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।
প্রত্যেক রোগীর কিডনির উপর ডায়াবিটিসের প্রভাব তাড়াতাড়ি জানার জন্য প্রতি তিন মাসে একবার রক্তচাপ এবং প্রস্রাবে প্রোটিনের মাত্রা পরীক্ষা করানো দরকার। রক্তচাপের বৃদ্ধি, প্রস্রাবে প্রোটিনের উপস্থিতি, শরীরে ফোলাভাব, রক্তে বারবার শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা কমে যাওয়া বা ডায়াবিটিসের জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিনের মাত্রা কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে কিডনি খারাপ হবার সম্ভাবনা। যদি রোগীকে ডায়াবিটিসের কারণে উদ্ভূত চোখের সমস্যার জন্য লেজার চিকিৎসা করানো হয়ে থাকে, তাহলে এইসব রোগীর ক্ষেত্রে কিডনি খারাপ হবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। কিডনিকে খারাপ হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য, ডায়াবিটিসের কারণে কিডনির প্রাথমিক চিকিৎসা দরকার। এজন্য প্রস্রাবের মাইক্রোঅ্যালবুমিন, ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষাই হল একমাত্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পরীক্ষা।
৩. উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা:
উচ্চ রক্তচাপ ক্রনিক কিডনি ফেলিওরের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অধিকাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপের কোনও লক্ষণ না থাকার কারণে, রোগী ব্লাড প্রেসারের ওষুধ অনিয়মিত ভাবে খায় বা বন্ধ করে দেয়। এইসব রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দীর্ঘ সময় ধরে বজায় থাকার ফলে কিডনি ফেল হবার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই দরকার। আর কিডনির উপর এর প্রভাবের শীঘ্র নির্ণয়ের জন্য বছরে একবার প্রস্রাবের এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিনের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
৪. ক্রনিক কিডনি ফেলিওরের রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা:
যদি কিডনি ফেলিওরের রোগী কঠোরভাবে খাদ্যপানীয় নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত চিকিৎসা এবং ঔষধ সেবন করেন তাহলে কিডনি বিকল হবার প্রক্রিয়াকে মন্থর করা সম্ভব এবং ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো চিকিৎসাকে এড়ানো সম্ভব। ক্রনিক কিডনি ফেলিওরের রোগীর কিডনিকে ক্ষতির থেকে বাঁচানোর জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল উচ্চ রক্তচাপের উপর সর্বদা এবং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ। এই জন্য রোগীর বাড়িতেই দুই থেকে তিনবার বি. পি. মেপে চার্ট বানানো দরকার। তাহলে ডাক্তারবাবু এই চার্ট দেখে ঔষধের রদবদল করতে পারবেন। রক্তচাপ সর্বদা ১৪০/৮৪ এবং এর নীচে লাভদায়ক এবং আবশ্যক। ১৩০-৭০-এর কম থাকলে আরো ভালো।
ক্রনিক কিডনি ফেলিওরের রোগীদের ক্ষেত্রে মূত্রমার্গে বাধা, পাথর প্রস্রাবে অসুবিধা বা অন্য সংক্রমণ, শরীরে জলের মাত্রা কম বা বেশি হওয়া (Dehydration) ইত্যাদির যথাসময়ে তৎপরতার সঙ্গে চিকিৎসা করালে কিডনির কার্যক্ষমতা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঠিক রাখা সম্ভব।
৫. বংশানুক্রমিক রোগ পি. কে. ডি'র নির্ণয় ও চিকিৎসা:
পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (পি. কে. ডি) একটি বংশানুক্রমিক রোগ। সেজন্য পরিবারে কোনও একজনের এই রোগ হলে পরিবারের বাকি সদস্যদের একবার পরীক্ষা করে এই রোগের অস্তিত্ব তাদের শরীরে যাচাই করে নেওয়া দরকার।
৬. বয়স্কদের প্রস্রাবে বার বার সংক্রমণের উচিত চিকিৎসা:
যে কোনও বয়সে, যদি প্রস্রাব বার বার হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে এর কারণ জানা দরকার। এর কারণ মূত্রমার্গে বাধা, পাথর ইত্যাদি হলে উচিত সময়ে চিকিৎসার দ্বারা কিডনিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।
৭. পাথর এবং বি. পি. এইচ. এর সঠিক চিকিৎসা:
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিডনি অথবা মূত্রমার্গে পাথরের নির্ণয় হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কিছু অসুবিধা হবার কারণে রোগীর চিকিৎসার প্রতি অবহেলা হয়ে থাকে। একইভাবে, বয়সকালে প্রস্টেটের অসুবিধার (বি. পি. এইচ) কারণে উৎপন্ন লক্ষণের প্রতিও অবহেলা করে থাকে। এইসব রোগীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় পরে কিডনির ক্ষতি হবার ভয় থাকে। এইজন্য সময় থাকতে ডাক্তারবাবুর পরামর্শমতো চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
৮. কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
সাধারণ 30 বছরের কমবয়স্ক ব্যক্তিদের উচ্চরক্তচাপ অস্বাভাবিক। কম বয়সে উচ্চরক্তচাপের অন্যতম প্রধান কারণ হল কিডনির রোগ। এইজন্য কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হলে কিডনির পরীক্ষা অবশ্যই করানো দরকার।
৯. অ্যাকিউট কিডনি ফেলিওরের শীঘ্র চিকিৎসা:
হঠাৎ কিডনি খারাপ হবার কারণগুলি হল, ডাইরিয়া, বমি, ম্যালেরিয়া, অত্যধিক রক্তস্রাব, রক্তের মারাত্মক সংক্রমণ, মূত্রমার্গে অবরোধ ইত্যাদি। এই সব সমস্যাগুলির শীঘ্র, উচিত এবং সম্পূর্ণ চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনিকে খারাপ হবার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।
১০. ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধসেবন:
সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে যে ঔষধগুলি সেবন করা হয় (যেমন যন্ত্রণা কমানোর ঔষধ) সেগুলি দীর্ঘদিন খেলে কিডনি খারাপ হবার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য অনাবশ্যক ওষুধ খাওয়ার প্রবৃত্তিকে এড়ানো দরকার, এবং অনাবশ্যক ঔষধাবলি ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো নির্ধারিত মাত্রা এবং সময়েই নেওয়া লাভজনক। সমস্ত আয়ুবেদিক ওষুধই ভাল এবং উপকারী-এটি একটি ভুল ধারণা। বেশ কিছু ভারী ধাতুর ভস্ম কিডনির জন্য খুবই ক্ষতিকারক।
১১. একটি কিডনিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা:
এক কিডনিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিক জল খাওয়া, প্রস্রাবের অন্যান্য সংক্রমণের শীঘ্র এবং উচিত চিকিৎসা করানো এবং নিয়মিত রূপে ডাক্তার দেখানো খুবই জরুরি।